কিচির-মিচির শব্দ করে পাখিরা নিড়ে ফিরছে। পোড়ামাটির গন্ধে ভরা বাতাসে আজানের সু-মিষ্ট সুর ভেসে আসছে। ছফুরন শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় দেয়। এমন সময় ফজলু মিয়া বেশ দূর থেকে রিক্সার বেল বাঁজাতে বাঁজাতে বাড়ি ঢুকছে। রান্না ফেলে ছুটে আসে ফজলুর কাছে। ওগো মনির বাপ, জ্বর বাইড়া গেছে নাকি! নিশ্চুপ থাকে ফজলু মিয়া। ছফুরন ছল ছল চোখে অভিমানের সুরে বলে, সেই সকালে রিক্সা নিয়া বাহির হইছো, কত কইলাম গায়ে জ্বর, আজ একটু দেরি করে বের হও। কেডা শুনে আমার কথা? ফজলু মিয়া রিক্সার সিটে বসা। ছফুরন হাত বাড়ায়। রিক্সা থেকে নামিয়ে ফজলু মিয়ার গায়ে-মাথায় হাত বুলায়। ওগো এ কি অবস্থা তোমার! খুব খারাপ লাগছে বুঝি? ফজলু মিয়া কিছু বলতে চাইলো কিন্তু সে সুযোগ না দিয়েই ছফুরন তাকে ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে এক কলস পানি আর বদনা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। ফজলু মিয়াকে খাটের ওপর বসা দেখে ছফুরন ধমকের সুরে বলে, কি ব্যাপার উঠে বসলে যে? একটুও কথা শোন না কেন? তারপর গলা নরম করে বলে, মাথায় পানি দিলে দেখবা আরাম লাগবে। ফজলু মিয়া ছফুরনের হাত থেকে পানির বদনাটা নিয়ে নিচে রাখে। তারপর পাশে বসিয়ে বলে, দেখ ছফুরন, আমার জ্বর বাড়েনি বরং জ্বর চলে গেছে। কলসটা রাখ। বিশ্বাস কর ইচ্ছা করেই আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছি।
- তাহলে গা গরম কেন?
- গা প্রতিদিনই গরম থাকে।
- কই আগেতো কখনো দেখিনি।
- আগে যখন বাড়িতে ফিরতাম তখন তুমি এই ভাবে কখনো দেখনি। অন্য দিনতো বাড়ি ফিরে গোছল শেষে ঘরে ঢুকতাম তাই দেহে তাপ থাকতো না।
শংকা কাটলো ছফুরনের। কিন্তু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কারণতো জানা চাই। তাই মিষ্টি হেসে ছফুরন বলে, আজ বুঝি ভাল ভাড়া পেয়েছো? প্রেমিক-প্রেমিকরা উঠছিলো বুঝি? ফজলু মিয়া হাসে, ওগো না আজ কালকার প্রেমিক-প্রেমিকারা এক টাকাও বেশি দেয়না। ওদের যে পরিমাণে মোবাইলে কথা বলতে হয় তাতে ওদের আরও দিলে ভালা হয়।
- তাহলে আজ কি এমন হয়েছে যে ভাড়া না মাইরা এতো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছো?
- রিক্সা চালানোর সময় আজ দেখছিলাম বড় বাজারের কয়েক যায়গায় ও এম এস চাল, বুঝলা না সরকারী চাল, বিক্রি হচ্ছে চলি¬শ টাহার চাল চব্বিশ টাহায় দেচ্ছ। আজ যা কামাই করছি তা দিয়া কালকের চাল হয়ে যাবে। কথা শেষে ফজলু মিয়া কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ছফুরনের দিকে। পরে ম্লান হেসে বলে, কত দিন তোমারে সঙ্গ দিতে পারিনে! সেই সকালে বেরিয়ে যাই আর ফিরি রাতে। দুই তিনটা মানুষের পেটের ভাত জোগাতেই এতো সময় লেগে যায়। তারপর দীর্ঘাশ্বাস ছেড়ে বলে, এই দশ বছরে কত মাইনুষরে চড়াইছি এই রিক্সায়। কত প্রেম ভালোবাসা আদর সোহাগ নিজের চোখে দেখেছি। যাত্রীদের এ ধরনের আদর সোহাগ দেইখ্যা খুব হিংসা হইতো। ফজলু মিয়া দু‘হাতের মধ্যে ছফুরনের একটা হাত নিয়ে বলে, বিশ্বাস করো ছফুরন মাঝে মধ্যে মনে হইতো ভাড়া না খাইট্টা তোমার কাছে ছুইট্টা আসি। কিন্তু পেটের কথা ভেবে আসতে পারিনি। আর অখনতো একেবারে অসম্ভব। চালের কেজি চল্লিশ টাকা, কাঁচা বাজারে আগুন, তেল আর মাছের দাম আকাশ ছোঁয়া। কবে যে জিনিসের দাম কমবো। একটা দীর্ঘাশ্বাস ছেড়ে ফজলু মিয়া ছফুরনের মুখোমুখি বসে। তারপর দু‘হাত দিয়ে মুখখানি ধরে আবেগ ভরা কন্ঠে বলে, ছফুরন বিয়ের প্রথম দিন গুলোর কথা মনে আছে তোমার? ছফুরন মাথা নাড়ে। মনে পড়ে সে দিনগুলোর কথা। রিক্সায় করে কত যায়গায় ঘুরতাম। প্রতিদিন ঘুরতাম বলে মাও কত না বকা দিত তোমারে। স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে দুষ্টমি ভরা দিনগুলো। লজ্জায় লাল হয়ে উঠে ছফুরন। ভাবতে অবাক লাগে এদিক সেদিক কত ঘুরাঘুরি তারপরও পেটের ভাত যোগাতে এতো সময় লাগতো না। অথচ এখন ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে শুরু হয় ওর রিক্সার প্যাডেল ঘুরানো আর থামে মাঝরাতে। তার পরও-----। কোথায় যে যাচ্ছে দেশটা, ভাবতে কষ্ট হয় ছফুরনের।
রাত ঘনিয়ে আসছে। আকাশের চাঁদ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। রূপালী চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে মাহি চৌধুরীর ফুলের বাগান। ফজলু মিয়া বউয়ের কোলে মাথা রেখে চৌধুরীর বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে। স্বামীর চুলের মধ্যে আঙ্গুল চালিয়ে আলতোভাবে চুল টানার এক ফাঁকে ছফুরন ফিসফিসিয়ে বলে, দেহ এই বয়সেও চৌধুরী সাহেব বউয়ের সাথে দোলনায় চইড়া দোল খাচ্ছে। ছফুরন ফজলু মিয়াকে বুকের সাথে চেপে ধরে। ফজলু মিয়া ছফুরনের সারা শরীরে আলতো হাত চালায়। শিশুর মতো আদর উপভোগ করলো ছফুরন। অনাবিল সুখে দুজনের মুখ থেকে একটি শব্দও বের হলো না। ঘরের মধ্যে শুধু নিশ্বাঃসের শব্দ। হঠাৎ জানালা দিয়ে এক ঝটকা বাতাস ঢুকলো। ছফুরনের চুলগুলো উড়ে এসে ঢেকে দিলো ফজলুর মুখ। বাতাসে শাড়ির আঁচল পড়ে গেল। ছফুরন শাড়ি টেনে দিতে চাইলো। ফজলু মিয়া বাঁধা দিল। চাঁদের আলোকছটা পড়ছে ছফুরনের শরীরে। ফজলু মিয়ার চোখে আজ চৈত্রের উত্তাপ নেই আছে শুধু ভালোবাসা। ছফুরনের কাজল টানা চোখ, মেদহীন শরীর, মুক্তো ঝরা হাসি। ফজলু হারিয়ে গেল অনাবিল সুখের সাগরে। ছফুরন হালকা ধাক্কা দিয়ে আহলাদি কন্ঠে বলে কাল থেকে তুমি প্রতিদিন তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরবা। টাকা যা হয় তা দিয়েই চলে যাবে। কাল থেকে আমি না হয় কম টাকায় ও এম এসের চাল কিনে আনবো।
২
ফজলু মিয়া ঘরের বারান্দায় বসা। রাগে গজ গজ করছে। সেই দুপুর থেকে না খাওয়া। মনে মনে অনেক কিছু ভাবছে। ছফুরন কি চাল আনতে গিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে? করিম সাহেবের ছেলে প্রায় ওর দিকে কু-নজর দিতো। ছফুরন কি তার সাথে গল্প জমালো? এলোমেলে ভাবনায় ফজলু মিয়ার বুক দুরু দুরু কাঁপছে।
বিকাল পাঁচটা। চালের প্যাকেট হাতে ছফুরন মাথা নিচু করে আসছে। ফজলু মিয়া উঠে দাঁড়ায়, সেই সহালে গেছো আর আসতাছো অহন। কি করতাছিলা এতক্ষন। মাইনুষেও কি গতর দেহাইয়া বেড়াইতাছিলা? রাগে গজ গজ করে কথাগুলো বলছিলো ফজলু মিয়া। ছফুরন উত্তর দেয় না। রিক্সার প্যাডেল ঘুরানো অনেক কষ্টের কাজ তার ওপর ক্ষিধার জ্বালা। পেটে কিছু পড়লে ঠিকই ভালো কথা বলবে। তাই দেরি না করে রান্না শুরু করে ছফুরন।
খাবার খেতে দিয়ে ছফুরন পাখা দিয়ে বাতাস করে আর বলে, লম্বা লাইন, অনেকে ভোর রাতে যায়গা ধরে রাখে, এই জন্য এতো দেরি হইছে। ফজলু মিয়া তাকায় ছফুরনের দিকে। চোখে মুখে ক্ষোভ নাই। খাওয়া শেষে হাত মুছতে মুছতে ফজলু মিয়া বলে, আমাগো ও এম এস চাল দরকার নাই ছফুরন। গরীবের এতো ভালোবাসা থাকতে নেই। ছফুরন কাছে গিয়ে বসে। হাত থেকে গামছা নিয়ে বলে, ওগো কাল একটু তাড়াতাড়ি যাইয়া দেহি সময় মতো পাওয়া যায় কিনা? তুমি আর না কইরো না। ফজলু মিয়া চাঁপা কন্ঠে বলে, আচ্ছা ঠিক আছে, দেখ কি হয়।
অনেক রাত। পৃথিবী প্রায় নিঝুম। ফজলু মিয়া ঘুমিয়ে আছে। ছফুরন বেশ কিছুক্ষন চেয়ে থাকে ফজলু মিয়ার দিকে। ওর ভালো লাগছিলো টুকরো সুখের মুহুর্ত গুলো মনে করে। পা টিপে টিপে জানালার কাছে আসে ছফুরন, তাকায় চৌধুরীর বাগানের দিকে। সব প্রকৃতি সেজেছে নতুন সাজে। পাশের পুকুরে মাছেরা খেলা করছে। চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করছে মাছগুলো। সব কিছুই সুন্দর লাগছে আজ। কিছুক্ষন উপভোগ করলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তারপর দেওয়ালে টাঙানো চালের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে জানালা বন্ধ করলো ছফুরন। এরপর খুব আস্তে আস্তে দরজা খুলে বের হয় বড় বাজারের পথে।
ফজরের আজানে ঘুম ভাঙ্গে ফজলু মিয়ার। ছফুরন পাশে নেই। ভাবে সকালের লম্বা লাইন এড়াতে হয়তো বাথ রুম সারতে গেছে । পাঁচটি রুমের ভাড়াটিয়াদের জন্য একটা মাত্র ল্যাট্রিন। মালিক বেটা বড় হাড় কিপ্টা। কিছুতেই আরেকটা ল্যাট্রিন বানাতে রাজি হয় না। ঘর থেকে বের হলো ফজলু মিয়া। ল্যাট্রিনে কেউ নেই। ঘরের আনাচে কানাচে কোথাও নেই ছফুরন। বেশ দুঃচিন্তায় পড়ে গেল ফজলু মিয়া।
হঠাৎ মনে পড়লো কাল রাতের কথা। ছফুরন বলছিলো একটু তাড়াতাড়ি গেলে সময় মতো ঠিকই চাল নিয়ে ফিরতে পারবে। তাহলে কি ছফুরন বড় বাজারে গেছে? অজানা আশঙ্খায় গা ছমছম করছে ফজলু মিয়ার। দড়ির পরে রাখা শার্টটা এক টানে নামিয়ে গায়ে দিলো ফজলু মিয়া। তারপর হাঁটে বড় বাজারের পথে।
কুয়াশা মাখা মায়াময় ভোর। প্রকৃতি সেজেছে আপন রঙে। পুব আকাশে লালিমা বেড়ে চলছে। বিষন্ন ফজলু মিয়া হাঁটছে, উপেক্ষিত হচ্ছে প্রকৃতির সাজ । খানিক দুর এগিয়ে রাস্তর বাম পাশে নজর গেল তার । হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে এক মহিলা । এগিয়ে গেল ফজলু মিয়া । রক্ত মাখা শাড়ি। মুখটা কাপড়ে ঢাকা। কাপড় সরাতেই চমকে উঠে। একি! ছফুরন যে। গলায় ফাঁসের দাগ। দুহাত দিয়ে মাথাটা উঁচু করে কোলের ওপর নিল। নিজেকে আর সামলাতে পারলোনা। চিৎকার করে উঠলো, ছফুরনরে কেডা তোর এ সর্বনাশ করলো। আল¬াগো আমার ছফুরনরে কেডা মাইরা ফালাইলো, কি দোষ আছিলো ছফুরনের। মুখে হাত বুলিয়ে ফুপিয়ে উঠে বলে, একটু সুখের লাগি ক্যান বাহির হইছিছ। অহন আমি কি করমু। ফজলু মিয়ার আর্ত-চিৎকারে বাতাস ভারি হয়ে উঠলো। মসজিদ থেকে মুসলি¬রা ছুটে আসলো। ফজলু মিয়া দুহাত আকাশের দিকে তুললো। বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলতে লাগলো, আল্লাগো তুমি আমার ছফুরনরে আমার কাছে ফিরাইয়া দেও।
ফজলু মিয়ার বুকফাটা আর্তনাদে যেন জমিন কেঁপে উঠলো। মাটির ঢিবিগুলো যেন তুলার মতো উড়তে লাগলো। বড় বাজারের উঁচু দালানগুলো যেন মুহুর্তে মিশে গেল মাটিতে।
No comments:
Post a Comment